হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাত নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। তবে কিছু মতাদর্শিক গোষ্ঠী উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ প্রশ্ন তোলে—“শিয়ারাই কি নিজেরা তাঁদের ইমামকে ডেকে এনে হত্যা করেনি?”
এই সন্দেহের ঐতিহাসিক সামগ্রিক জবাব হচ্ছে: ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রকৃত হত্যাকারীরা ছিলেন উমাইয়াপন্থী ও উসমানিয়াগ্রাহী কুফাবাসীরা, যারা আদর্শিকভাবে শিয়াদের বিরোধী ছিল।
কুফার বাস্তবতা ও বিভক্ত জনগোষ্ঠী
আশুরার সময় কুফায় দুটি স্পষ্ট ধারার অস্তিত্ব ছিল:
১. উমাইয়াপন্থীরা (উসমানিয়াগ্রাহী, শাসকগোষ্ঠীর অনুসারী)
২. শিয়ারা (আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসাপূর্ণ জনগোষ্ঠী)
তবে কুফাবাসীদের বড় অংশ ছিল মানসিক দিক থেকে দুর্বল—তারা সন্দেহ ও আবেগে বিপর্যস্ত, দুনিয়াপ্রীত, যুদ্ধক্লান্ত এবং গোত্রনেতাদের অন্ধ অনুসারী। এই সব কারণে তারা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পক্ষ না নিয়ে শত্রুপক্ষে অবস্থান নেয়, যদিও তাদের দুর্বল হৃদয় ইমামের প্রতি অনুগত ছিল।
ফরযদাক কবির বিখ্যাত উক্তি এখানে প্রাসঙ্গিক:
“তাদের হৃদয় তোমার পক্ষে, কিন্তু তরবারি তোমার বিরুদ্ধে।”
মুহিব্বিন বনাম আদর্শিক শিয়া
[] ইবনে জিয়াদের ভয়-প্রলোভনে যারা ইমামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল তারা ছিল কেবলমাত্র “মুহিব্বিন/ভক্ত” (শিয়ায়ে মুহাব্বতি), যারা ইমামত ও আহলে বাইতের আদর্শে পূর্ণ বিশ্বাসী ছিল না। তারা কেবল ইয়াজিদের তুলনায় ইমাম হুসাইন (আ.)’কে অধিক ভালোবাসত ও খেলাফতের জন্য অধিক যোগ্য মনে করত। তারা ইমাম হুসাইনের (আ.) পক্ষে সমর্থন জানালেও সকল প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করার মত ঈমানি দৃঢ়তা তাদের ছিল না।
[] আদর্শিক শিয়ারা, যারা ঈমান ও আদর্শের এমন পর্যায়ে ছিলেন যে— ইমাম হুসাইনের (আ.) আহবানে তাঁর নির্দেশ পালনে এবং অধিকার রক্ষায় হাজার বার শাহাদাত বরণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। যেমন—হাবীব ইবনে মাযাহির, মুসলিম ইবনে আওসাজা, বুরাইর ও আবু সুমামা—প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ইমামের পাশে এসে শহীদ হন।
ইমামের হত্যাকারীদের পরিচয়
ইমামের হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িতরা ছিলেন: উমর ইবনে সাদ, শিমর, আমর ইবনে হাজ্জাজ, শাবেস ইবনে রিব’ই প্রমুখ। তাঁরা সকলেই ছিলেন উমাইয়াপন্থী ও উসমানিয়াগ্রাহী, যারা পূর্বে আহলে বাইতের বিরোধিতা করেছিল এবং কুফার সাহসী শিয়াদের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্রমূলক ও মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিল।
কারবালার দুই পক্ষের আদর্শিক পার্থক্য
কারবালার দুই বাহিনী ছিল আদর্শিকভাবে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী:
প্রথমত, ইমাম হুসাইনের (আ.) বাহিনী ছিল আদর্শিক শিয়াদের দল, যারা রাসুলুল্লাহ (সা.) পর আদর্শিকভাবে ইমাম আলীকে (আ.) অনুসরণ করত।
দ্বিতীয়ত, উমর ইবনে সাদের বাহিনী ছিল উসমানিয়াগ্রাহী উমাইয়া সমর্থক, যারা রাজনৈতিক ও দুনিয়াবি উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করেছিল।
সিফফিনের যুদ্ধে নাফে ইবনে হিলাল যেমন বলেছিলেন, “আমি আলী’র অনুসারী”, আর তার প্রতিপক্ষ বলেছিল, “আমি উসমানের অনুসারী”।
তেমনি কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.) নিজেও বলেন, “হে বনি উমাইয়ার অনুসারীরা!” —এটি প্রমাণ করে, ইমামের বিরোধীরা কোনোভাবেই শিয়াদের আদর্শ বহন করত না।
কুফাবাসীদের মনস্তত্ত্ব ও অস্থিরতা
বিভিন্ন বর্ণনায় আছে, কুফা থেকে পাঠানো সৈন্যদের এক বড় অংশ মাঝপথে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে, যাদেরকে ইতিপূর্বে ইমাম হুসাইনের (আ.) শিয়া নয়, কেবলই মুহিব্বিন হিসেবে উল্লেখ করেছি। এদের কেউ কেউ আবার হুসাইনের (আ.) প্রতি মমতা দেখিয়ে দোয়া করত, অন্যদিকে ইমামের সন্তানদের মালামাল লুট হতে দেখে কাঁদত— কিন্তু উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর সেনাদের ভয়ে প্রতিবাদ করত না।
এই দ্বৈত আচরণ ইঙ্গিত দেয়—অনেকেই কেবল আবেগের বশবর্তী হয়ে ইমামের পক্ষে ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল না আকিদাগত বিশ্বাস, সাহস ও আদর্শগত দৃঢ়তা। তাদের হৃদয় ও কাজের মধ্যে ফারাক ছিল স্পষ্ট।
উপসংহার: ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের জন্য শিয়ারা দায়ী—এমন ধারণা ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মিথ্যা। প্রকৃত অপরাধীরা ছিলেন উমাইয়া ঘরানার অনুসারী ও উসমানিয়াগ্রাহী শাসকদের প্রতিনিধি।
আদর্শিক শিয়ারা ইমামের সঙ্গে থেকে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। সুতরাং, এই বিভ্রান্তিমূলক প্রচার শুধুই ইমাম হুসাইনের (আ.) হত্যাকারীদের পক্ষে ইতিহাস বিকৃতি ও সত্য আড়ালের অপপ্রয়াস।
সংকলন, অনুবাদ ও পরিমার্জন: রাসেল আহমেদ রিজভী
আপনার কমেন্ট